কুয়াশামোড়া কোলাখাম
কোলাখামকে বিদায় জানিয়ে যখন আমাদের গাড়ি স্টার্ট করল পাহাড়ি রাস্তায় তখনও কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি নেচে কুঁদে এগিয়ে চলল। উত্তরবঙ্গের আর পাঁচটা পাহাড়ের মতোই সামনের চালচিত্র; একদিকে পাহাড় আর এক দিকে খাদ। তবে এ খাদের তল দেখা দায়! হরেক সবুজে ঢাকা পড়েছে তার শরীর। আর চোখের সমান্তরালে দূরে, আরও দূরে অপসৃয়মান পাহাড় শ্রেণীর ঘুম ভাঙছে। পাহাড় চূড়ার মাথায় তখনও সাদা মেঘের পাগড়ি। ঘণ্টা খানেক আগে হোমস্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই পাহাড়ের মাথাতেই সূর্যোদয়ের ম্যাজিক শো দু’চোখ ভরে দেখেছি। চতুর্দিকে হিমালয়ান পাখিদের কিচিরমিচির; চি-ই-ই-ই, উইশ-শ-শ, ক্যা-আ-ক, চি-চি- চি- চি আরও কত কী! রাস্তার দু’পাশে, খাদের জঙ্গলে, গাছের ডালে সর্বত্র তাদের আনাগোনা। এডাল ওডালে এমন ছুটোছুটি করছে যেন ভীষণ এক জরুরী কাজের বরাত পেয়েছে! একটা ন্যাড়া গাছের মাথায় পাহাড়ি ময়না চোখে পড়ল। ঈশান কোণে ঘাড় উঁচিয়ে ভোরের আলাপ জমিয়েছে। নিঝুম প্রকৃতির বুকে এক অদ্ভুত শব্দ জগৎ! Nature Orchestra! এ ভাবে মন ভোলানো প্রকৃতিকে সঙ্গী করে ঘন্টাখানেক চলার পর পাহাড়ের এক বাঁকে ড্রাইভার ভাই গাড়ি থামালো।
রাস্তার ডানদিকে খাড়া পাহাড়। আর বাঁদিকে খাদ। খাদের পানে আঙুল দেখিয়ে ড্রাইভার সোনম শেরপা বললে, “ইধার চলা যাইয়ে। ওয়াটারফল মিল জায়েগা।” গাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। পিচ রাস্তার পাশে খানিকটা জমি। তারপরই পাহাড়ের ঢাল। সেই ঢাল বরাবর একটা শুঁড়িপথ পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। ক্যামেরা কাঁধে চড়িয়ে হাঁটা লাগালাম। খানিক পরেই পথ ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করল। চারিপাশে জন মনিষ্যির নাম গন্ধ নেই। শুধু জঙ্গল, ঘন জঙ্গল। জলপ্রপাত দূরস্থান একটা নালার উপস্থিতিও ঠাহর হচ্ছে না। এভাবে বিজন পাহাড়ে গাইড ছাড়া হেঁটে যাওয়া আদেও কী সমীচীন! এসব সাত পাঁচ ভাবনা যখন ব্রহ্মতালুতে ঘূর্ণি কাটছে, ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ালো এক চার পেয়ে পাহাড় বাসী। উদগ্রীব মনকে খানিক শান্ত করতে সেই না-মানুষ সুধাই,
“ সনম দাজু বুঝি তোকে গাইড বানিয়ে পাঠিয়েছে?” লোমস ঘন লেজটা খাড়া করে আকাশের পানে খানিক ঘাড় উঠিয়ে সে বুঝি প্রতুত্তর দিল
-ভো-উ-উ-উ-উ-উ
-তা, পারিশ্রমিক কত রে তোর?
-ভো-উ-উ-উ-উ-উ। গলা চড়িয়ে আবারও তার একই জবাব।
এরপর সে দুলকি চালে দুলকি চালে নধরকান্তি শরীরটা দুলিয়ে এগিয়ে চলে। এখন সঙ্গী পাহাড়িয়া গাইড। হোক চারপায়ী। বিনি পয়সায় মন্দ কী! মন বুঝি খানিক সোয়াস্তি পেল! তাকে অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম। মাটি-পাথরের উতরাই পথ। কিন্তু বিধি বাম! সে হিমালয়চারীর গতির সাথে পা মেলাব, এ শহুরিয়ার কলিজায় সে দম কই! এক বাঁকের ওপারে এসে সারমেয় গাইড লা পাতা। অতঃপর, আবারও একলা চলো রে… আরও কিছুটা উতরাই পথ চলার পর হঠাৎ যেন কানে এল এক মৃদু কলতান।কান খাড়া হতে বুঝতে অসুবিধা হয়না, এ শব্দ ধ্বনি নিশ্চিত কোন জলপ্রপাতের। তার অর্থ, ঠিক পথেই চলেছি। এবার পথ দেখাল সেই ‘রিনঝিন’। সেই নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম। সময়ের সাথে সাথে সেই শব্দ তরঙ্গ ক্রমশ তার ডিসিবেল বাড়াল। এক সময় পথ পাথুরে সীমারেখা টানল। প্রায় নব্বই ডিগ্রী ঘাড় উঁচিয়ে দেখতেই দৃষ্টি স্থির, নাদ ব্রহ্মে সম্মোহন! উপরের পাহাড় দিয়ে সবেগে ঝাঁপ দিয়েছে এক দামাল জলপ্রপাত, আচম্বিত। নিঝুম পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে তীব্র জলধারার বিরামহীন নিনাদ। নিচে আছড়ে পড়ছে তার শ্বেতশুভ্র
জলরাশি। অতঃপর পাথর আর বোল্ডারের চারপাশে সাদা আলপনা আঁকতে আঁকতে এক সময় নেমে গিয়েছে নীচের পাহাড়ে। নিশ্চিদ্র সবুজে গহীনে আবার হঠাৎই সে অদৃশ্য! খানিক ধূমকেতুর মত যেন তার চাল চলন! চোখে পড়ল সেই ক্ষণিকের সারমেয় গাইড মশাই এক স্থানীয় তরুনীর সাথে এদিকেই আসছে। কাছে আসতে সে পাহাড়িয়া জানায় এটাই ছাঙ্গে ফলস্, উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ উচ্চতার জলপ্রপাত । জনা কয়েক কিশোর কিশোরী চোখে পড়ল। কেউ মুঠোফোনে সেলফি তুলছে, আবার কেউ ঝরনার জলে ভিজে সোৎসাহে চিৎকার জুড়েছে। সেই যৌবনের উল্লাস যেন চিরযৌবনা জলপ্রপাতের সাথে মিশে গেল! খানিক সময় কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরতে যাব হঠাৎ চোখ গেল পাহাড়ের গায়ে; সবুজ ঘন পাহাড়ের বুকে নাম না জানা অর্কিড ফুটেছে। সবুজের ক্যানভাসে বেগুনি রঙা অর্কিডের মনকাড়া কনট্রাস্ট। ঝরনার হাওয়ায় অর্কিডের পাপড়িগুলো ক্রমশ দোল খাচ্ছে এদিক সেদিক। যেন মর্তের পরি ডানা মেলে ওড়ার অপেক্ষায়!
বাতাসের শরীরে আবার অন্য ম্যাজিক! ঝর্ণার জল পাথরে পাহাড়ে আছড়ে পড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে জলকনার সৃষ্টি করছে, তারা বাতাসে ভেসে উপরে উঠে আসছে। আর পুবের পাহাড় টপকে সকালের সূর্য সেই জলকণাদের শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে! যেন হাজারো মণিমুক্ত জ্বলজ্বল করে উঠছে! ছাঙ্গের জলকণা ভিজিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। আর বুঝি ভিজে চলে মন দরিয়া! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখি গহীনের গোপনে বয়ে যাওয়া এই অনন্ত আনন্দধারাকে। মন যেন তার আকাশ খুঁজে পায়! এবার ফিরতে হবে। ওপরে ড্রাইভার ভাই অপেক্ষায়। হিমালয়ের মনিমুক্তকে মনের মনিকোঠায় সযত্নে ভরে, ছাঙ্গের শীতলতায় মন ভিজিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম…
কিভাবে যাবেন : ছাঙ্গে জলপ্রপাতটি পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায়। কোলাখাম থেকে মোটরপথে দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। রাস্তার শেষে জলপ্রপাতে পৌঁছানোর জন্য একটি ছোট হাঁটা পথ ধরে প্রায় ৯০০ মিটার ট্রেক করতে হবে। লাভা গ্রাম থেকেও যাওয়া যায়। দূরত্ব ১০ কিমি। নিকটতম বিমানবন্দর হল বাগডোগরা এবং নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি জংশন। কিছু ভ্রমনার্থীদের জন্য ট্রেকটি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে সবুজে ঘেরা জলপ্রপাত নিশ্চিত মন কাড়বে ।
কোথায় থাকবেন: কোলাখামে একাধিক হোমস্টে রয়েছে। আমরা ছিলাম ‘নিউ সাইলেন্ট ভ্যালি’ হোম স্টে-তে( contact person; অনিন্দ সাহু +919831197917)